চেতনায় দেবভূমি – দেওঘর

সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ ভাদ্র ১৩৫৩ বংগাব্দ। 

দেওঘর রোহিণী রোড। বড়াল বাংলো ( একালে যার নাম সৎসঙ্গ মেমোরিয়াল) । এখানেই এসে উঠলেন প্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর। হিমাইতপুরে বিশাল কর্ম প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার বিঘা ভূমি সম্পত্তির একটুও বিক্রয় করা হয়নি। শ্রীশ্রীমাতা মমনোমোহিনী দেবীর নামে প্রতিষ্ঠিত  ” মনোমোহিনী কলেজ অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি ” ওখানে প্রতিষ্ঠিত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়  কর্তৃক অনুমোদিত এই প্রতিষ্ঠান। সবকিছুই সংরক্ষিত হোক আকুলতা ঠাকুরের। 

কিন্তু সারাদেশে ব্যাপক সংকট বাড়ছে। দেশ বিভক্তির আলামত প্রকট। এই সময়ে ৩৪তম ঋত্বিক অধিবেশন। শ্রীশ্রীঠাকুরের দেওঘরে আগমনের পর এখানে প্রথম ঋত্বিক অধিবেশন। বেলা দশটা। বড়াল বাংলোর পশ্চিমপাশেই রোহিনী রোড। পশ্চিমে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা শীর্ণ দারোয়া নদী।  নদী, মাঠ, রেললাইন পেরিয়ে দূরে অটল প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে থাকা ডিগরিয়া পাহাড়। পাশাপাশি তপোবন, ত্রিকূট এইসব পাহাড়ের মালা। নিচে কাঁকর বিছানো লালমাটি। সবুজ শ্যামলিমায় ঘেরা ফেলে আসা বাংলা নয়।

ঋত্বিক সংঘের কর্মতৎপরতা সম্বন্ধে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন   ” আমার দৃঢ় বিশ্বাস, চারটে লোক যদি উঠে পড়ে লাগে তবে কাজের জন্য হাজার লোক জোগাড় করতে পারে। তোমরা কি বুঝতে পারো না আমার অবস্থা কত বেদনাদায়ক। আমার ভয়নক কষ্ট, লোকের দুঃখ, দুর্দশা ও বিপদের কথা ভেবে আমার শ্বাসরুদ্ধমত মনে হয়। দীর্ঘসূত্রী অভ্যাস হলে কি আগন্তুকসমূহ বিপদের বিরুদ্ধে বজ্রকপাট এটে নিরাপত্তাকে সুদৃঢ় করে তোলা যায়? একটুখানি সময় আমাদের আছে। এরই মাঝে সেরে নিতে হবে।”

ঋত্বগাচার্য শ্রীকৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য বললেন পূর্ববঙ্গে কি এখন আগের মত কাজ করা সম্ভব হবে? রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তনের অসুবিধাতো হতে পারে।

শ্রীশ্রীঠাকুরের বক্তব্য, কোন রাষ্ট্রই লোকের অকল্যাণ চাইতে পারে না। লোক অসৎ হোক, উচ্ছৃঙ্খল হোক, নিজের অমংগল চাইতে পারে না। আমরা  ঈশ্বরকে মানি, রসুলকে মানি, সেই সংগে সংগে মানি প্রত্যেকটি প্রেরিতপুরুষকে। মানি সনাতন ধর্মকে যা প্রতিটি মানুষকে  আত্মনিয়ন্ত্রণের পথে বাঁচা বাড়ায় পৌঁছে দেয়। তাই আমরাও ইসলামকে বাদ দিয়ে নই, ইসলাম ও আমাদের বাদ দিয়ে নয়। এককথায় বাঁচা বাড়ার ক্ষুধা আছে যাদের, পরমপিতার পায়ে শান্তিতে বসবাস করবার, অভ্যুদয়শীল হয়ে পারস্পরিক প্রীতি  নিয়ে জীবন উপভোগ করবার লালসা আছে যাদের, তাদের সংগে আমাদের বিরোধ হবার কথা নয়। যদি কেউ বুঝতে না পেরে বাধার সৃষ্টি করে, তাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিলেই বুঝবে। আলোচনার তারিখটা ছিল  ১৯৪৭ এর ১১ নভেম্বর। 

আটচল্লিশের জানুয়ারী ৩০। কুষ্টিয়া থেকে প্রবীণ সহ প্রতি ঋত্বিক শ্রী বিষ্ণুপদ বিশ্বাস মহোদয়কে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন শ্রীশ্রীঠাকুর ওখানকার (পাকিস্তানের) স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে ভাল যা বিশেষতঃ বাস্তুভিটা ইত্যাদি তা কখনো ছাড়বে না”।

ঠিক ঐ দিন আগের সন্ধ্যায় মহাত্মা গান্ধীর তিরোধান ঘটেছে। সংবাদ পাওয়াবধি শ্রীশ্রীঠাকুর নিদারুণ বিমর্ষ। ব্যথা নিয়ে বললেন দল নির্বিশেষে সকলে অন্তরের সংগে শ্রদ্ধা করে এমন দ্বিতীয় মানুষ আজ আর কাউকে দেখি না। পরম পিতার কি ইচ্ছা জানি না। একে দেশ বিভাগ হয়ে গেল, তারপরে এই দুর্দৈব।”

মহাত্মাকে এইভাবে মারলো এর চাইতে Shoking (বেদনাদায়ক) আর কিছু নেই।”

২ ফেব্রুয়ারী বেলা তিনটের দিকে শ্রীশ্রীঠাকুর মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুতে ইংরাজি ও বাংলায় শোকজ্ঞাপক বাণী করলেন ” বাংলা বাণীটি :

” যে গুলি মহাত্মাকে গুলি বিদ্ধ করেছে

সে গুলি সত্তানুরাগী সবারই হৃদয়কে 

আবিদ্ধ, বিদীর্ণ করে ফেলেছে।

মহাতাপস! তোমার আশীর্বাদ যেন সবারই অন্তর্নিহিত অমংগলকে

চিরদিনের মতো অবলুপ্ত করে।

পরমপিতা! 

মানুষের যে এ অবদান

তুমি মংগলে পূর্ণ করে তোল। “

বিভক্ত উপমহাদেশ, বিপন্ন জন জীবন, মৃত্যুর মহোৎসবের নৃশংসতা সারা দেশজুড়ে, মহাত্মা গান্ধীর করুণ মৃত্যু এ সবই শ্রীশ্রীঠাকুরকে দারুণ ব্যথিত করেছে। আপন শারীরিক অসুস্থতার মধ্যেও কল্যাণ স্রোতা জীবন চেতনার বাস্তবায়ন  তাঁর নিরন্তর।  জরুরি  কাজতো একটাই। কিছু আত্মনিবেদিত বাস্তব কর্মী  সংগ্রহ।

তারই জন্য তাঁর যতি আশ্রম। বেশ কিছু ভক্ত ‘যতি’ তৎপরতায় আত্মসমর্পণ করেছেন। এদের নিয়েই নিরন্তর  আলোচনার  সুযোগ প্রদান তাঁর।আমাদের অস্তিত্বের আশ্রয়ভূমি পৃথিবী।একটিই পৃথিবী। পৃথিবীর মাটিতে একটিই চাঁদ। মাটি, জল, আকাশ, বাতাস সবকিছুতেই সম অধিকার সবার। সম্প্রদায়ের নামে বিরোধ তাই নির্বোধ আত্ম হননেরই নামান্তর। এই সিদ্ধান্ত তাঁর চিরকালের। মাতৃভূমি ছেড়ে পুণ্যভূমি  দেওঘর ধামকে এই নতুন দেব ভূমিকে নব রূপায়ণে নরলস প্রচেষ্টা তাঁর। পরিবেশগত  প্রকৃতি আর জনজীবনের সব সংকটের মধ্যেও  ভেবে চলেছেন  মংগল নিষ্যন্দী নিরলস কর্মতৎপরতা। 

দারোয়া থেকে গংগা পদ্মার জলস্রোতের অবাধ বিস্তার সংযোগ। সেটি সম্ভব হলে কি বিশাল মংগল যজ্ঞ! গুণিজনকে তা নিয়ে ভাবিত করেছেন। সুযোগ পেলেই যাকে বলার তাকে বলছেন। উৎসাহিত করছেন। গংগা দারোয়া পরিকল্পনা। 

বহু আগে বলেছিলেন উইলককক্স, বেন্টালী যে Irrigation plan (সেঁচ পরিকল্পনা)  দিয়েছে, আমি বাঁচি বা মরি, এটা আপনাদের করাই চাই। এতে Climate, production (আবহাওয়া, উৎপাদন)  সব কিছু ভাল হবে। শুধু বাংলা নয়, সারা Province (প্রদেশেই) এই কর চাই এবং সেটা যত  তাড়াতাড়ি পারেন ততই ভাল।’ ১৯৫৪ এর আগস্ট মাসের চার তারিখে তাঁর বলা কথা। দেওঘরে বসেও সেই নদী সংস্কার প্রকল্পের আকুলতা। দেওঘর হতে হিমাইতপুর  জল সংযোগ আর জন সংযোগের বান্ধব বন্ধনের আকুলতা।

” চাই….  Divine unity, ugenic culture,agriculture,irrigation এবং industry ( ভাগ্যবতী  ঐক্য,  সুপ্রজনন, কৃষি,  পূর্তকর্ম এবং শিল্প)  নিয়ে বৈশিষ্ট্যপালী সম্বর্দ্ধনী সংহতির পথে অগ্রসর হওয়া, এই বাদ দিয়ে কিছু হবার নয়,” বলেছিলেন কথাটি এর তিনদিন আগে। দেব ভূমিতে সেই পরিকল্পনা  নব রূপায়ণের স্বপ্ন। ছোটবেলায় কাশীপুরের পাঠশালার পথে হাটতে  হাটতে  দেখেছিলেন ঐ মাটিতে আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয়  প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। দেওঘরেও তাই নিয়ে নতুন ভাবনা। গড়ে উঠুক মানুষগড়ার আদর্শ কারখানা। শাণ্ডিল্য  বিশ্ববিদ্যালয়।  কর্ম ভক্তি আর জ্ঞান। জীবন চেতনার ত্রিধারার একায়নী আশ্রয়।

(সংগৃহীত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *