হিরন্ময় ঘোষ ·
১৩৩১ বঙ্গাব্দ । দোল-পূর্ণিমার পুণ্য প্রভাতে সাধক-প্রবর মহারাজ অনন্তনাথ রায় প্রাণের একতারার সুরটা মহাপ্রভুর আবির্ভাব তিথি উপলক্ষ্যে সাধতে গিয়ে অনুভব করলেন, মহাপ্রভু তো নব-কলেবরে সন্নিকটে বিরাজমান। না, আর দেরি নয়, আজই। চৈতন্য মহাপ্রভুর নব-কলেবরকে নবীনভাবে রাঙাতে হবে। দোল উৎসব করতে হবে। মহারাজ গিয়ে গোঁসাইদাকে বলতেই আনন্দে নেচে ওঠেন গোঁসাইদা। আনন্দ-সন্দেশ পৌঁছে যায় কিশোরীমোহনের কাছে, হেমকবির কাছে। ক্রমে ছড়িয়ে পড়ল বার্তা সারা আশ্রমে।
“পদ্মার ধারে বাবলা গাছের ডালে কাপড় দিয়ে চৌকি বেঁধে দোল-মঞ্চ তৈরী হয়েছে। একটায় হুজুর মহারাজের ছবি, একটায় সরকার সাহেবের ছবি বসানো হয়েছে। আবাল-বৃদ্ধ নর-নারী ফাগুয়া উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা। মহারাজ গেলেন মায়ের কাছে, মাকে দোল উৎসবের কথা জানালেন এবং দোল উৎসবে তাঁর আগমন ও যোগদানের প্রার্থনা জানালেন। মা রাজী হলেন। এই কথা জেনে মহারাজ শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে গিয়ে বললেন—‘‘ঠাকুর, আপনার দোল-উৎসবের আয়োজন হয়েছে। আপনাকে মঞ্চে বসিয়ে সকলে সমবেত প্রার্থনা করি, এই আমাদের কামনা।”
মহারাজের সঙ্গে আগত সকলের সাগ্রহ প্রার্থনায় রাজী হয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর স্বর্গীয় পিতৃদেবের ফটোতে পায়ে আবির দিয়ে শ্রীশ্রীমায়ের পায়ে আবির দিলেন। তারপর মঞ্চের সামনে এসে একে একে হুজুর মহারাজের ও সরকার সাহেবের ফটোতে আবির দিয়ে ঝুলন্ত মঞ্চ দুটি দুলিয়ে দিলেন।
ভক্তরা শ্রীশ্রীঠাকুরকে তৃতীয় মঞ্চে বসার জন্য প্রার্থনা জানালো, কিন্তু ঠাকুর প্রথমে দোলায় বসতে রাজী হলেন না। … মা ঠাকুরকে ডাকলেন—‘অনুকূল’। ঠাকুর নীরবে ছোট্ট শিশুর মত মায়ের সামনে এসে দাঁড়লেন। মাকে দোলায় বসানো হলো। ঠাকুর মায়ের আদেশে মায়ের কোলে বসলেন। ……”
স্বভাব কবি হেমচন্দ্র তাঁর তাৎক্ষণিক সঙ্গীতের ডালি সাজিয়ে গাইতে সুরু করলেন,—
“ধন্য দ্বাপর লীলা ফাগ দিলে আজ
তোমার পায়।
কি দেব যায় তোমায় মানায়
প্রণাম যেথায় লজ্জা পায়।।
মধু মাসে মধুর খেলা
আজ আমাদের মধু উৎসব
পদ্মাতীরে বাবলা তলার প্রাঙ্গণে
আজ মিলেছি সব।।”
ভক্তরা সারিবদ্ধভাবে মা ও ঠাকুরের রাঙা চরণ আরো রাঙিয়ে দিলেন আবির দিয়ে। ঠাকুর মায়ের কোলে বসেই আবির ছড়িয়ে রাঙিয়ে দিচ্ছেন ভক্তদের। সুরু হলো তুমুল কীর্তন। ‘মহারাজ, কিশোরীমোহন, গোঁসাই পরস্পরকে আবির মাখিয়ে দিলেন, সৎসঙ্গীরা তাঁদের পায়ে আবির দিয়ে প্রণাম করলো।’
“তারপর আরম্ভ হলো উদ্দাম রঙের খেলা। কীর্ত্তনের দল নিয়ে গ্রাম পরিক্রমায় বের হলেন সৎসঙ্গের ত্রয়ী। মহারাজের হাতে বিরাট একটি পিতলের পিচকারি। দু’জন বাহক একটি শক্ত বাঁশের মাঝখানে বেঁধে বিরাট এক ড্রাম বোঝাই গোলা রং নিয় চলেছে সঙ্গে। হিন্দুপাড়া, বাগ্দি পাড়া, ব্রাহ্মণ পাড়া সর্ব্বত্র ঘুরছে কীর্ত্তনের বিরাট দল। প্রতিটি গৃহের সবাইকে রাঙ্গিয়ে দিচ্ছেন মহারাজ। পাকা বাড়ীর ছাদ থেকে মায়েরা লাজ, ফুল, আবির বৃষ্টি করছেন কীর্ত্তন দলের উপরে। আর মহারাজ নীচে থেকেই পিচকারীর রঙে তাঁদের রাঙ্গিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে ৩/৪ খানা গ্রাম ঘুরে সবাইকে দোল উৎসবে মাতিয়ে রেখে বিকেলে কীর্ত্তন দল ফিরে এল আশ্রমে। সঙ্গে দোর্দ্দণ্ড উদ্দাম নৃত্য সহকারে কীর্ত্তন চলছেই।”
“এরপর পদ্মায় স্নানোৎসব চললো প্রায় সন্ধ্যা পর্য্যন্ত। সেও এক মহা-মহোৎসব যেন। সন্ধ্যার পর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে সবাই আনন্দবাজারে প্রসাদ পেয়ে ধন্য হ’ল।”
(সূত্রঃ বাসুদেব গোস্বামী বিরচিত গ্রন্থ ‘পুরুষোত্তম-লীলাপার্ষদ মহারাজ অনন্তনাথ…..’)